সংগৃহীত সংবাদ:
জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রস্তুত করেছে বিএনপি। ‘জাতীয় ঐকমত্যের রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র’ শিরোনামে এটি তৈরি করা হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি ধরে এবং বাহাত্তরের সংবিধান সমুন্নত রেখে এতে ১৭টি দফা রয়েছে। ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মতামত নেওয়া শুরু করেছে বিএনপি। তাদের মতামতের ভিত্তিতে এটা চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে উত্থাপন করা হবে। দলটি বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে এটি তৈরি করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে বিএনপি।
এ খসড়া ঘোষণাপত্রের ওপর সমমনা দলগুলোর মতামত নিতে তাদের সঙ্গে বৈঠকও শুরু করেছে বিএনপি। গতকাল শুক্রবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১২ দলীয় জোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে বৈঠকে ঘোষণাপত্রের খসড়া দেওয়া হয়। আজ শনিবার এ বিষয়ে এলডিপি ও জাতীয়বাদী সমমনা জোটের সঙ্গে বৈঠক হবে। পর্যায়ক্রমে যুগপৎ আন্দোলনের অন্য দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে খসড়াটি দেওয়া হবে। সমমনা দলগুলোর মতামত নেওয়ার পরই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা হবে।
Google News গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সরকার তাদের মতো করে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেছে। বিএনপিও তাদের মতো করে খসড়া তৈরি করেছে। ছাত্রদের দাবিকে অগ্রাহ্য না করে আমরা ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। খুব তাড়াতাড়ি এটি সরকারকে দিয়ে দেব।
এর আগে ১৬ জানুয়ারি ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর এক দিন আগে বিএনপি ও জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ২৫ দফার জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া দেওয়া হয়। বাহাত্তর সালের সংবিধান সংশোধন কিংবা প্রয়োজনে বাতিল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণের গত ১৫ বছরের সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়াসহ অভিপ্রায় তুলে ধরা হয়। প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে অংশ নিলেও ঘোষণাপত্র নিয়ে মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকে বিএনপি।
গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাসের মাথায় এই ঘোষণাপত্র নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপিরও এ বিষয়ে আগ্রহ নেই। ঘোষণাপত্র নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অনড় থাকলেও বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল এটির প্রয়োজন দেখছে না। অন্যদিকে সরকারের একটি সূত্র থেকে জানা যায়, জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া অনিশ্চিত। তবুও জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রস্তুত করেছে বিএনপি।
১৭ দফায় বিভক্ত এ ঘোষণাপত্রে বিদ্যমান সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গুম, খুন, হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের অপরাধের বিচার, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে। এতে শেষে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী নিম্নোক্ত রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহ এই ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করছি।
ঘোষণাপত্রে বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও সবশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে সংঘঠিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্রুত বিচারের দাবি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া এতে বলা হয়, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হাসিনা সরকার চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক, ও মানবাধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। বাংলাদেশের আপামর জনগণ ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিবৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে।
এতে আরও বলা হয়, বিদেশি রাষ্ট্রের অন্যায় প্রভুত্ব, শোষণ ও খবরদারির বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে তল্পিবাহক আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠুর শক্তি প্রয়োগ করে দমন করেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিগত তিনটি নির্বাচন প্রহসনের মধ্য দিয়ে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, দীর্ঘদিন ভোটাধিকার ও চাকরিতে একচেটিয়া দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়োগের ফলে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চাকরিপ্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম হয়। ক্ষোভ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলন দমাতে গিয়ে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপক দমন-পীড়ন ও গণহত্যা চালানোর ফলশ্রুতিতে সারা দেশে দলমত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণঅভ্যুথানে সব ছাত্র-জনতার পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী শ্রমিকসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। এ সময় রাজপথে নারী-শিশুসহ দুই হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা করে। গুলি ও শারীরিক নির্যাতনে অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে।
এতে আরও বলা হয়, গণঅভ্যুথানে সকল শ্রেণিপেশার আপামর জনসাধারণের রাস্তায় নেমে আসার পর অবৈধ, অনির্বাচিত, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তিতে ওইদিন রাতে বঙ্গভবনে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে অবৈধ সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়।
Leave a Reply