যেখানে নদী কথা বলে, সেখানে মানুষ চুপ করে শোনে। কুড়িগ্রাম এমনই এক জেলা, যেখানে প্রকৃতি প্রতিদিন নতুন গল্প শোনায়—ব্রহ্মপুত্রের ঢেউয়ে, চরবাসীর মুখে, শীতের কুয়াশায়, বর্ষার হাহাকারে। অথচ সেই গল্পগুলো কেউ লিখে রাখে না। এই জেলাকে ঘিরে যেমন আছে নিঃশেষ সম্ভাবনা, তেমনি আছে চোখ ভেজানো বাস্তবতা।
নদীর আলিঙ্গনে গড়া জনপদ
প্রায় ৫২ নদ নদী নিয়ে গড়ে ওঠা কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের মানচিত্রে এক অনন্য ব্যতিক্রম। এখানকার চরজমি যেন ঋতুর হাতে আঁকা চলমান এক পেইন্টিং। বর্ষায় হাঁটু পলি জমে, শীতে ধান-কলাই-কাউন-বাদামে ভরে যায় মাঠ। কিন্তু এসবই যেন কেবল চোখের দেখা, অনুভবের জন্য দরকার হৃদয়ের দরজা খুলে রাখা।
ভোরের চিলমারী বন্দর দেখলে মনে হয়, সূর্য যেন এখানে আলো ফেলার আগে একটু থেমে নদীর দিকে তাকিয়ে নেয়। ঢেউয়ের গায়ে পড়ে থাকা আলো, মাঝি-মাল্লাদের নৌকা, জেলেদের ছুঁড়ে ফেলা জাল—সব মিলিয়ে একটি জীবন্ত চিত্রকলা। এই জীবনের কোনো তাড়াহুড়া নেই, কিন্তু প্রতিদিন তারা নদীর বুক চিরে সংগ্রাম করে বাঁচে।
ইতিহাসের কণ্ঠস্বর এখনো জেগে আছে
রৌমারী, চিলমারী, ভূরুঙ্গামারী—এসব জায়গা শুধু ভৌগোলিক পরিচয় নয়, ইতিহাসের গায়ে খোদাই করে রাখা নাম। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে রৌমারী ছিল একমাত্র পূর্ণাঙ্গ মুক্তাঞ্চল, যেখানে প্রশাসনিক কাঠামো থেকে শুরু করে রাষ্ট্রচিন্তা পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছিল। অথচ আজও সেই স্মৃতি পড়ে আছে অনাদরে, সংরক্ষণের তাগিদ নেই কোথাও।
সম্ভাবনার নাম—পর্যটন
বাংলাদেশের পর্যটন মানেই সুন্দরবন, কক্সবাজার, বান্দরবান বা সিলেট কিংবা রাঙামাটি। কেউ ভাবে না কুড়িগ্রামের কথা। অথচ এই জেলার চরজীবন, খাদ্যসংস্কৃতি, ভাওয়াইয়া গান, নদীমাতৃক প্রকৃতি—সব মিলিয়ে এক অসাধারণ পর্যটনগন্তব্য তৈরি হতে পারত। এখন সারা পৃথিবীতেই ‘কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম’ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কুড়িগ্রামের চরের মানুষ যদি অতিথি রাখার পরিবেশ তৈরি করেন, তবে পর্যটকেরা বড় হোটেলের চেয়ে এই খাঁটি জীবনের সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি আগ্রহী হবেন।
এতে যেমন স্থানীয়দের আয় বাড়বে, তেমনি রক্ষা পাবে ঐতিহ্যবাহী চাল, ডাল, শাক আর গল্পের চাষ। চরের ডাল, শুটকি আর ভাওয়াইয়া গান—এসবই হতে পারে কুড়িগ্রামের স্বকীয় ব্র্যান্ড।
একটা মেলা, একটা দীর্ঘশ্বাস
চীলমারীর অষ্টমীর মেলা ছিল এক সময়কার প্রাণ। ভারতের আসাম , কোচবিহার, জলপাইগুড়ি থেকে মানুষ আসত, ১৫ দিনের মেলায় ঢল নামত মানুষের। আজ সেই মেলা ব্যর্থ এক অপেক্ষা মাত্র। অব্যবস্থা, উদাসীনতা আর অবহেলা মিলিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি কী ছিল, আর কী হতে পারত।
রেল আর নদী—দুই পথেই সম্ভাবনা
ঢাকা থেকে সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেনে কুড়িগ্রাম আসা যায়। চাইলে রাতের ঘুম শেষ করে ভোরবেলা পৌঁছে যাওয়া যায় ব্রহ্মপুত্রের কোলে। আবার কেউ চাইলে নদীপথে চিলমারী হয়ে ঢাকায় ফিরতেও পারেন। এই ভ্রমণটাই তো এক পর্যটন।
কুড়িগ্রাম মানে শুধু প্রান্তিকতা নয়
কুড়িগ্রাম মানে শুধু বন্যা, নদীভাঙন আর গরিবের গল্প নয়। কুড়িগ্রাম মানে এক গভীর শিকড়, যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে না লড়ে, বরং পাশাপাশি হেঁটে চলে। এই জেলার প্রতিটি চর, প্রতিটি নদী, প্রতিটি গান—সবই বাংলাদেশের আত্মার অংশ।
রাষ্ট্র যদি একটু এগিয়ে আসে, গণমাধ্যম যদি একটু বলে, আর মানুষ যদি একবার দেখতে চায়—তবে কুড়িগ্রাম হতে পারে বাংলাদেশের এক নতুন চিন্তার নাম।
এই ধুলোয় জন্ম, এই মাটিতেই শিকড়—সেই কুড়িগ্রামকেই যদি আমরা না চিনলাম, তাহলে আর কাকে চিনব?