আব্দুন নুর আজাদ,ঠাকুরগাঁও
গত কয়েকদিন ধরে ঠাকুরগাঁও জেলায় বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ধান ও ভুট্টা চাষে চরম সংকটে পড়েছেন কৃষকরা। হঠাৎ করে ধেয়ে আসা দমকা হাওয়া, মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি আর মেঘলা আবহাওয়ায় মাঠের পর মাঠ ফসল ক্ষতির মুখে। জেলার অধিকাংশ কৃষক এখন আতঙ্কে, কীভাবে তারা এই ক্ষতি সামলাবেন।
মাঠভরা ফসল এখন শঙ্কায়
সদর উপজেলার বলিদাপাড়া গ্রামের চাষি ফজলুল হক বলেন,
“ধান পাকতে শুরু করেছিল, আমরা কাটা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু গত তিনদিনের বৃষ্টিতে অনেক গাছ হেলে পড়েছে। কিছু জমিতে পানি জমে থাকায় গাছ পচে যাচ্ছে।”
তাঁর মতো হাজারো কৃষক এখন ধান কাটা শুরু করলেও, বৃষ্টির কারণে জমি কাদায় পরিণত হওয়ায় শ্রমিক নামানো যাচ্ছে না। আবার অনেক কৃষককে দেখা গেছে নিজেরাই কোমর পানিতে নেমে ধান কাটতে।
ভুট্টার ক্ষেতেও দুর্যোগের ছাপ
এ বছর ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল ও হরিপুর উপজেলায় ভুট্টা চাষ হয়েছে ব্যাপক হারে। কিন্তু সাম্প্রতিক বৃষ্টির কারণে বেশ কিছু এলাকায় ভুট্টা গাছ লিফ ব্লাইট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অতিরিক্ত আর্দ্রতায় পাতায় ছোপ ছোপ দাগ পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় চাষি লুৎফর রহমান জানান,
“ভুট্টা গাছ আগা থেকে পাতা পর্যন্ত পচে যাচ্ছে। আগে ফলন দেখে মনে হয়েছিল সব ঠিক আছে। এখন ফলন ঘরে তোলা নিয়েই টেনশনে আছি।”
অঞ্চলভেদে ক্ষতির ধরন আলাদা
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, আবহাওয়ার প্রভাবে প্রতিটি উপজেলায় ভিন্ন রকমের ক্ষতি হয়েছে—
সদর ও রুহিয়া: ধানে পানি জমে গাছ নষ্ট।
পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈল: ভুট্টা গাছে লিফ ব্লাইট ও শিকড় পচা রোগ।
বালিয়াডাঙ্গী: বাতাসে ধানগাছ মাটিতে পড়ে যাওয়া এবং জমিতে জলাবদ্ধতা।
নারী কৃষকদের দৃশ্যমান অংশগ্রহণ
ক্ষতিগ্রস্ত ফসল ঘরে তুলতে এখন পুরুষের পাশাপাশি মাঠে কাজ করছেন নারী কৃষকেরাও। রানীশংকৈলের সরাসরি মাঠ পর্যায়ে দেখা গেছে, অনেক নারী কাদামাটিতে নেমে ধান কাটছেন। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে তাঁদের এই অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা বাড়ছে
বেশিরভাগ কৃষকই ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেছেন। কিন্তু এখন ফলন যদি আশানুরূপ না হয়, তাহলে ঋণ শোধে পড়বেন বড় দুশ্চিন্তায়।
পীরগঞ্জের কৃষক জয়নাল বলেন,
“ভুট্টা থেকে অন্তত ৫০ হাজার টাকা আসবে ভেবেছিলাম, এখন তো সেটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে।”
একইসঙ্গে, শ্রমিক সংকট ও বাড়তি মজুরি কৃষকের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
চাষযোগ্য জমি ঝুঁকিতে, খরিপ মৌসুমেও প্রভাব
আবহাওয়া দীর্ঘস্থায়ী হলে জমি শুকাতে সময় লাগবে, ফলে খরিপ-১ মৌসুমের বীজ বপনের সময় পিছিয়ে যেতে পারে। এতে প্রভাব পড়বে সামগ্রিক কৃষি চক্রে। বিশেষ করে যারা ধান কাটার পর সবজি বা অন্যান্য ফসল চাষের পরিকল্পনা করেছিলেন, তারাও এখন অনিশ্চয়তায়।
প্রশাসনের আশ্বাস থাকলেও মাঠে এখনো তেমন সহায়তা নেই
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন,
“আমরা তালিকা করছি। কোথায় কী ক্ষতি হয়েছে তার ভিত্তিতে সহায়তা চাওয়া হবে। কিছু জায়গায় বিশেষ স্কিমের আওতায় ত্রাণ ও বীজ সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।”
তবে কৃষকরা বলছেন, শুধু পরিকল্পনা নয়, এখনই কার্যকর সহায়তা দরকার।
বাজারে প্রভাব: ভুট্টার দাম বাড়ছে
ফলন বিপর্যয়ের প্রভাব এরই মধ্যে বাজারে পড়তে শুরু করেছে। ভুট্টার কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ২–৩ টাকা। ধান ও চালের দামেও প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত
কৃষিবিজ্ঞানী ড. মনিরুল ইসলাম বলেন,
“আবহাওয়ার এমন আচরণ জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট লক্ষণ। কৃষিকে টেকসই করতে হলে এখন থেকেই প্রশিক্ষণ, আধুনিক চাষাবাদ ও দুর্যোগ প্রস্তুতির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।”
মাঠে দাঁড়ানো ধান ও ভুট্টা যেন এখন শুধুই গাছ নয় — এগুলো কৃষকের স্বপ্ন, বিনিয়োগ, ভবিষ্যৎ। আর সেই স্বপ্ন এখন প্রকৃতির ছোবলে ঝুঁকিতে। সরকারি সহায়তা এবং সময়োপযোগী ব্যবস্থা ছাড়া এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না।